০৪ মে ২০২৫, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

গ্রাম বাংলার খণ্ড চিত্র

মোঃ রুহুল আমিন || ২২ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:০৪ পিএম
গ্রাম বাংলার খণ্ড চিত্র


হুনছেন মামা,বাদ আছর টেরার বিচার।কোন টেরার? উত্তর পাড়ার কডা টেরার। তার একটা সুন্দর নাম আছে,সরাফত আলী।নেতিবাচক কিছু বৈশিষ্টের কারণে এ নামে এখন আর কেউ ডাকে না তারে।নাম হয়ে গেছে কডা টেরা। টেরায় কী করছে? টেরার ক্ষেতের ধান গরু খাইয়া ফালাইতাছে হুইন্না,কান্দার আইল দিয়া দিছে লৌড়, রাস্তায় হুজ্জত মিয়ার বউ গেদা কোলে খাড়াইয়া আছিল,টেরার ধাক্কা লাইগ্যা উল্টাইয়া পড়ছে,পোলাডা ছিটকা পড়ছে,হাত ভাইঙ্গা গেছে,মাথায় চোট পাইছে,বৌডার কোমর ভাঙছে,কপাল ছিল্লা গেছে।টেরার এদিকে খেয়াল নাই,এদিক ওদিক তাকানোর ফুরস্যুৎ নাই,বাতাসের গতিতে ছোটে,উষ্ঠা খাইয়া পড়ে,আবার উঠে,জান দিয়া চালি দেয়,হাফাইতে হাফাইতে দৌঁড়ায়।কষ্টের ধান রক্ষা করতেই অইব।গিয়া দেহে, গরুরা ভোজন শেষে তৃপ্তিসহ হেইল্লা দুইল্লা চইল্লা যাইতাছে।আনন্দের সাথে জাবর কাটতাছে।এ দৃশ্যে ওর ভিতরটা ফানাফানা হইয়া যায়,কপালে হাত চাপড়ায়,চিৎকার করে,সারা বছরের খোরাক গরুর পেটে।পোলাপান লইয়া খামু কী? গরুর পেছনে ছোটার শক্তি অবশিষ্ট নেই।মনে তীব্র কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে ফিরে টেরা।উৎকণ্ঠিত টেরার মনেই নেই যাওয়ার পথে ধাক্কা লাগার ঘটনা। 

এদিকে হুজ্জত মিয়া হুমকিধামকি করতাছে,দেইখ্যা লমু,টেরারে ঝাঁঝরা কইরা ফালামু,আমার বউয়েরে ধাক্কা দিছে,ঠ্যাং কাইট্টা ফালামু,চোখ খুইল্লা ফালামু! আরও কত কী লোমহর্ষক শব্দ বর্ষণ,গগন বিধারী চিৎকার,কী লম্ফজম্ফ!হুজ্জত বিচার চাইছে পঞ্চায়েতের কাছে।আজকা জব্বর বিচার অইব। আছরের পর শালিশ শুরু হয়েছে।হুজ্জত মিয়া পুরো বিষয়টি সবিস্তারে ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের মত করে উপস্থাপন করল।এও বলতে কসুর করল না,টেরা ছাহেরা বানুরে বিয়া করতে চাইছিল,টেরার কাছে দেয় নাই; ব্যর্থ হইছে,না পাওয়ার ক্ষোভ আর যন্ত্রণার পরতিশোধ নিছে।

বিচার মজলিশে টেরার বয়ান শুরু হয়েছে। ধান খাইয়া ফালাইতাছে হুইন্না আমার মাথা গরম অইয়া গেছে, মাথা চক্কর খাইছে, ভন ভন কইরা ঘুরতাছিল।চক্ষে-মুখ্যে কিছু দেহি নাই, খালি দেকছি ধান ক্ষেত সাফ হইয়া যাইতাছে, গরুর পেটে আমার সারা বছরের খোরাক।রাস্তায় কেডা আছিল খেয়াল করি নাই। ধাক্কা লাইগ্যা থাকবার পাড়ে,তয় ইচ্ছা কইরা ধাক্কা দেই নাই। হুজ্জত আলীর বউ নাকিকান্না আর বিলাপের সুরে কয়,ইচ্ছা কইরা ধাক্কা দিছে, আমার দিকে চাইয়া আমার বরাবর লৌড় দিছে।টেরায় কয়, হেরে আমি দেহি নাই।হুজ্জত কয়,উচিত বিচার চাই,নইলে মামলা করমু।পঞ্চায়েত প্রধান হালকা ধমক দেয় , তোমরা থাম।ঠাহর করতাছি,ভুল বোঝাবুঝি হইছে।বুঝতে হইব,টেরার লক্ষ্য থাকে যেদিকে,ওর চোখ থাকে অন্যদিকে।প্রত্যক্ষদর্শি আরও কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হল।পক্ষচারণ করে সাক্ষ্য দিচ্ছে কেউ কেউ।কেউ কেউ মিশ্রিত,পক্ষে-বিপক্ষে।বিষয়টা খোলসা হল না তেমন। ধোঁয়াশা রয়ে গেল।অভিযোগ যথার্থ প্রমাণিত না হলেও হুজ্জতের স্ত্রী ও ছওয়াল ভালই আঘাত পেয়েছে,তা বোঝা গেছে।দক্ষিণ পাড়ার আরেক টেরায় কয়,ওর নজর বালা না।আমিও কয়দিন দেকছি,তাকায় এক দিকে নজর অন্যদিকে।কতার লছম নাই,তয় হাছা কথা কয়।

বিচারে সাব্যস্ত হল, হুজ্জতের স্ত্রীপুত্রের চিকিৎসার খরচ দিব টেরায়।মাফ চাইব হুজ্জতের বউয়ের কাছে।এখন থেকে লক্ষ্য আর দৃষ্টি এক হইতে হইব । টেরা কয়,আমার ধান গেল, মান গেল,এখন জরিপানা দিতে অইব বিনা দোষে। আপনাগো পরতি আমার শ্রদ্ধা আছে,বিচার মানলাম,তয় আমার একখানা কতা আছে।সালিশদের এক জন কয়,কও,কী কবার চাও। টেরা কয়,আমিত দেহি গ্রামের অনেকেই বেকা করে তাকায়, দোষ পড়ে খালি আমার।অগো দিল টেরা,মন টেরা, স্বভাব টেরা,কথা টেরা,নিয়ত টেরা,লক্ষ্য টেরা,কাজ টেরা।হেগো মনে বিষ বাইরে মধু,হাতে ফুল মনে ছুরি, বাইরে সাধু ভিতরে শয়তান,সামনে একরূপ পিছে অন্য,ঘন ঘন রূপ বদলায়,সুযোগ বুইজ্জা মিছা কথা কয়, কতা ঘুরায়। অগো বিচার অইব না? হুদা আমার দোষ ? সবাইরে ঠিক হইতে কন।বিচার সবার জন্য হমান।নচেৎ আমার প্রতি জুলুম অইব,অবিচার অইব।শালিশিগণ বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে,এগুলান নিয়া অন্য একদিন বইতে অইব।বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। এগুলো ক্রনিক সমস্যা।সমাজকে জটিল করে তোলে,জটিল করে জীবন, অশান্ত হয় চিত্ত,অস্থির করে জীবন প্রবাহ,বিনষ্ট হয় জীবনের নান্দনিকতা।

লেখক : সাবেক পরিচালক , ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর



আরো পড়ুন